দৈনিক সান্তাহার

গতি আনছে আদমদীঘি গ্রামের তাঁতিরা

sanatar newsসান্তাহার ডেস্ক:: তাঁতশিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা বেগবান রাখতে অবিরাম কাজ করে চলছে বগুড়া জেলার আদমদিঘির নশরৎপুর ইউনিয়নের শাঁওইল এবং এর আশপাশের ৭৫টি গ্রামের বাসিন্দারা। দেশের নানা স্থানের গার্মেন্ট থেকে ঝুট বা পরিত্যক্ত কাপড় কিনে তা থেকে সুতা বের করে সেই সুতা রিসাইকেলিং করে আবার নতুন সুতা তৈরি করা হয়। এরপর এই সুতা দিয়েই নানা রকম পোশাক তৈরি করছে সেখানকার তাঁতিরা। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে হাঁট। প্রতিবছর ৫০০-৬০০ কোটি টাকার কাপড় বেচাকেনা হয়ে থাকে শাঁওইল হাটে। তবে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা, যাতায়াতের রাস্তা অনেকটাই সরু, সুতা ডাইং করার ফ্যাক্টরি এবং হাট বসার নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এখানকার ব্যবসায়ীদের। তবে প্রাথমিকভাবে ঋণ ও ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের সাহায্য সহোযোগিতা করছে এসএমই ফাউন্ডেশন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে এখানকার তাঁতশিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
১৯৮৫ সাল থেকে শাঁওইল গ্রামে এ তাঁতশিল্প গড়ে ওঠে। সে সময় উলের সুতা সংগ্রহ করা হতো। ১৯৮৮ সালে ঢাকার গার্মেন্ট থেকে সুতা সংগ্রহ করা শুরু হয়। বগুড়ার আদমদিঘি উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত শাঁওইল বাজার। এই বাজারে সপ্তাহে দুই দিন বুধবার ও রোববার হাট বসে। এ হাটে ১২০০-এর বেশি দোকান রয়েছে। শাঁওইলসহ এখানকার প্রায় ৭৪টি গ্রামে এ তাঁতশিল্প রয়েছে।
সরজমিন শাঁওইল বাজার ঘুরে দেখা যায়, গ্রামে প্রবেশ করতেই রাস্তার দুই ধারে রয়েছে জুট কাপড়ের অসংখ্য দোকান। এসব দোকানে কেউ কাপড় থেকে সুতা বের করছে কেউ বা আবার সেই সুতা কেউ বিক্রি করছে। এসব দোকানের কর্মচারীরা হচ্ছে মূলত নারী। প্রতি দোকানে গড়ে ৩ জন করে বেশ কয়েক হাজার নারী এসব দোকানে কাজ করে থাকেন। এ ছাড়া প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ও ঘরে বসানো পরিপাটি
তাঁতযন্ত্র দিন-রাত চাদর, কম্বলসহ নানা রকম কাপড় বুনিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে তাঁতযন্ত্র। কোনোটা চাকাওয়ালা আবার কোনোটা একেবারেই বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি। শাঁওইল ছাড়াও দত্তবাড়িয়া, মঙ্গলপুর, দেলুগঞ্জসহ আশপাশের প্রায় ৭৫ গ্রামের চিত্র একই রকম। এসব গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মূল পেশা তাঁত। এখানকার ১০ হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবারকে ঘিরে ৫০ থেকে ৬০ হাজারের বেশি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলছে। এখানে কেউ বংশ পরম্পরায় আবার কেউ নতুন করে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
শাঁওইল বাজারের ব্যবসায়ী জনি জানান, এখানকার তৈরি চাদর কম্বল ও গামছা অত্যন্ত উন্নতমানের হওয়ায় দেশ-বিদেশে চাহিদা বাড়ছে। আমরা ১০-২৫ টাকা কেজি দরে গার্মেন্টসের ঝুট কিনে আনি। এর পর তা থেকে সুতা বের করি। সেই সুতাকে আবার ডাইংয়ের মাধ্যমে নতুন রূপ দেয়া হয়। আমরা সুতাও বিক্রি করে থাকি। তিনি অভিমান করে বলেন, কোনো ধরনের প্রচার ও সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই এখানে গড়ে উঠেছে একটি বিশাল কর্মক্ষেত্র। শীতকালে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। আমরা এসব কাপড়ের কিছুই ফেলি না। যে সব সুতা কাজে লাগানো যায় না সেগুলোকে আমরা তুলা বানিয়ে বিক্রি করি। শাঁওইল গ্রামের কোহিনূর বেগম এখানে ২৬ বছর ধরে কাপড় থেকে এক রঙের কাপড় আলাদা করে তা থেকে সুতা বের করার কাজ করছেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করে তিনি ১২০ টাকা মুজুরি পান। এ দিয়েই চলে তার সংসার।
এখানকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দেশের তাঁতশিল্পের ইতিহাসে বড় ভূমিকা রাখছে বগুড়ার আদমদিঘির শাঁওইল বাজার। বছরের ছয় মাস লেডিস চাদর, কম্বল, মাফলার, জাকেট তৈরি ও বেচাকেনা বেড়ে যায় হাটে। তবে আমাদের এখানে হাট বসার নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ব্যবসায়ীদের রাস্তায় দোকান দিতে হচ্ছে। এতে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ঢাকা, চিটাগাং, সিলেট, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহীসহ সারাদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা এসে চাদর, কম্বল ও উলেন সুতা কিনে ট্রাকযোগে নিয়ে যান। আমাদের গ্রামে আসার রাস্তা অনেক সরু তাই ট্রাক ঢুকতে সমস্যা হয়। এ ছাড়া এখানে নেই কোনো ডাইন মেশিন বা ফ্যাক্টরি। এতে অন্যত্র গিয়ে ডাইং করে ৩০-৪০ হাজার টাকা খরচ হয় প্রতি গাড়িতে। সরকার যদি আমাদের এ সমস্যাগুলো সমাধান করে তাহলে তাঁতশিল্পকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
নশরৎপুর ইউনিয়নের তন্তুবায় সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন জানান, শাঁওইল হাটে ছোট-বড় মিলে প্রায় ১২শ দোকান রয়েছে। আর তৈরি হয়েছে নতুন নতুন কারিগর। খুব উন্নতমানের চাদর হওয়ায় এই চাদরের চাহিদা বাংলাদেশে ব্যাপক আর এ চাদরগুলো পৃথিবীর নানা দেশেও যায়। বিভিন্ন গার্মেন্টের সোয়েটারের সুতা প্রক্রিয়াজাত করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরি হয় কম্বল ও চাদরসহ নানা পোশাক। তিনি বলেন, দেশের বড় বড় কোম্পানি আমাদের এখান থেকে কাপড় কিনে। আমাদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে ডিজাইনের জন্য মেশিনও নেই। ব্যাংকঋণ নিতে অনেক সমস্যা পোহাতে হয়। এ ছাড়া সরকারি সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। বেসরকারিভাবে এসএমই ফাউন্ডেশন উদ্যোক্তাদের ঋণ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সরকারিভাবে এসব সুবিধা তাঁতিদের মাঝে বাড়াতে পারলে গ্রামটি হতো একটি দৃষ্টান্তমূলক রপ্তানির ক্ষেত্র।
এসএমই ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের বিকাশ ও উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই শিল্পায়ন এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে সরকারের ভিশন ২০২১ অর্জনে এসএমই ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের মাঝে ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া ফাউন্ডেশন বিভিন্ন মেয়াদে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে এখানকার উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুমুখী প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। ফাউন্ডেশন ক্লাস্টারটির উদ্যোক্তাদের পণ্যের ওয়েবসাইট প্রস্তুতকরণ এবং পন্য রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণে কাজ করছে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেন, বগুড়া একটি বিশাল সম্ভাবনাময় জেলা। নানা সমস্যার কারণে এই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বগুড়ার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের জমি সংকট, স্বল্প সুদে ঋণ না পাওয়া, দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। অথচ এ শিল্পখাত কৃষি যন্ত্রাংশের ৮০ ভাগ ও শীত বস্ত্রের প্রায় ৯০ ভাগ পূরণ করতে সক্ষম। এজন্য সরকার এই খাতকে এগিয়ে নিতে বগুড়ায় ২৫১ একর জমিতে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার ঘোষণা দিয়েছে। যেখানে এই খাতের জন্য নিদিষ্ট পরিমাণ জমি বরাদ্দ রাখা হবে। যাতে করে তারা গুচ্ছ হয়ে ব্যবসা করে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। এ ছাড়া সরকার বগুড়ায় একটি রেললাইন, বিমানবন্দর ও চার লেনের রাস্তা করারও পরিকল্পনা নিয়েছে।

>> সান্তাহার ডটকম/ইএন/৮ মে ২০১৭ইং