গুণীজন

১৯৭১ এর স্মৃতি; আমার বাবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। পর্ব-১

ইঞ্জিনিয়ার এস, এম রায়হানুল ইসলাম রায়হান :: আমি ১৯৭১ সালের কথা বলব, আমি আমার বাবার কথা বলব। স্বাধীনতাযুদ্ধ আমার জীবনের ঘটে যাওয়া একটা সবচেয়ে বড় অধ্যায়। স্বাধীনতা সংগ্রাম আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে ভিন্নভাবে। ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল এই ৪৯টি বছর যাবত বহন করে আসছি এক বিশাল গল্প। এক বিভীষিকাময় অনুচ্ছেদ, এক দুঃস্বপ্ন, মহা এক আতঙ্ক, এক ভয়, এক ভীতি, এক যন্ত্রণা এবং এক না বলা বীরগাথা। সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা বার বার প্রত্যহ মনের পর্দায় ভেসে উঠে। জীবন থেকে উড়ে গেছে ঘটনাবহুল এই কয়েকটি মাস; আপাতঃ দৃষ্টিতে যদিও মনে হবে অল্প কয়েকটা দিন কিন্তু বাস্তবতায় ঐ দিনগুলো ছিল বাঙ্গালী জাতির জীবনের তথা আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়; এ রকম সময় আমি চাই না অথবা আশাও করি না, আসুক আর কোন আমার মত ২০ বছর বয়সী যুবক জীবনে এই পৃথিবীর কোন দেশে। সে যেন এক বিভীষিকাময় প্রহর। শত্রুর বিমান হামলা, শহরের দুই প্রান্ত থেকে শত্রুর অনুপ্রবেশ– গগন বিদারী গোলাগুলির আওয়াজ, বিমানের ভূমিকম্পসম বিদীর্ণ আওয়াজ, ভয়ঙ্করভাবে অপ্রকিতস্তু হবার মত গুলিবর্ষণ ও বোমা বর্ষণ।

তাইতো হৃদয়ের স্পন্দের সাথে গাঁথা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তার ইতিহাস নিয়ে যেই অনুসন্ধান, আবৃতি, অবচেতন মনেই কেমন জানি অমোঘভাবেই পৌঁছে তার নিকট, খুঁজে পাই এক অবারিত সংহতি, এক পারস্পরিক নির্ভরতা তারই পথ ধরে আমার সাথে এক সম্পৃক্ততা।

নওগাঁ জেলার নওগাঁ সদর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম দোগাছী। ১৯৫১ সালের ২৪ অক্টোবর সে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মো. মোজাহারুল ইসলাম সরদার। বাবা হাজী মৃত জহির উদ্দিন সরদার পেশায় একজন চাকরিজীবি ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ে চাকরি করতেন এবং পাশাপাশি গৃহস্থ কাজ করতেন। মা আয়মন বিবি ছিলেন একজন গৃহিনী। উনারা চার ভাই আর এক বোন। বড় ভাই আলহাজ্ব মো. আফজাল হোসেন উনি একজন সমাজসেবক এই ৯৪ বয়সে এসে ও সমাজসেবা ও মানবসেবা করে যাচ্ছেন। উনার বাবার সন্তানের মধ্যে তিনি ছোট সন্তান। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক এবং সান্তাহার বি. পি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অল্প বয়সে সংসারের দায়িত্ব নেয়ার কারণে পড়াশোনা বেশি এগিয়ে নিতে পারেননি। ঠিক যুদ্ধদের তিন বছর আগে তখনকার পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সকলস্তরেই তিনি শিক্ষকদের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেক অনুষ্ঠানের সংগঠক হিসাবে কাজ করেছেন।

তার স্ত্রী মোছা ইয়ারুন নেসা ও এক কন্যা এবং দুই ছেলে নিয়ে তার সুন্দর সাজানো ছন্দময় পরিবার। ১৯৭২ সালে বিয়ে করেন। তার বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার এস এম রায়হানুল ইসলাম ঢাকাতে কর্পোরেট অফিসে চাকরি করেন। ছোট ছেলে মো. রাশেকুল ইসলাম ঢাকাতে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন।

দুই. মা-মাটি-মাতৃভূমি ও বাঙালির আত্মপরিচয় নিহিত বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অমোচনীয় ইতিহাসে। ইতিহাস ও আত্মপরিচয় ছাড়া কোনো জাতি দাঁড়াতে পারেনি। যে জাতির কোনো ইতিহাস নেই, সে জাতির বর্তমান কিংবা আগামী নেই। অতীতই আমাদের প্রেরণা ও শক্তি। ১৯৭১ আমাদের ইতিহাসের সেই রক্তাক্ত অধ্যায়, যার লাল-কালো অক্ষরের ভেতরে আছে বাঙালির শক্তি ও অস্তিত্ব।

আমি ১৯৭১ সালের কথা বলব। শরণার্থী জীবনের কথা বলব। শুধু স্মৃতিচারণ নয়, আত্মজীবনের জার্নাল। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলার সন্তানদের ডাক দিয়েছিলেন। তার ডাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সাড়া দিয়ে আমাদের টগবগে পূর্বপুরুষরাই দেশ স্বাধীন করেছেন। আমার পিতা ছিলেন তাদের একজন। তাই এ লেখার সর্বাংশে জড়িয়ে আছে আমার বাবার স্বপ্ন ও লড়াই। বাবার আত্মজীবনের লড়াইকে লিখতে এসে একজন লেখকের ভূমিকাই নিজেকে তৈরি করলাম।

আমি পূর্বপুরুষের লড়াইয়ের কথা, আমার বাবার কথা বলতে চাই। আমি জানি, দেশের প্রতি দায় ও আত্মঅস্তিত্বের এই লেখা কখনোই মূল্যহীন হয়ে যাবে না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এসব লেখা অমূল্য হয়ে উঠবে। উত্তরাধিকারীরাই ইতিহাসের ভাষা ও শক্তিকে বহন করেন। আমাদের কৃতি, স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে তাদের কাছেই রেখে যেতে হবে। উত্তরাধিকারের পথরেখায় ওরা পথ চলতে থাকুক। আত্মপরিচয়ের শক্তিতে বেঁচে থাকুক।

আমি তো লেখক নই। শব্দের সঙ্গে বসবাস করতে শিখিনি। খাতা-কলম নিয়ে, একটা দায় ও দায়িত্ব নিয়ে লেখার টেবিলে বসে থাকি। ফ্রেমে বাঁধা বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি ও দর্শনকে লিখতে চেষ্টা করেছি।

নওগাঁ জেলার আমার জন্ম। নওগাঁ সদর থানা শহরের পাশে দোগাছী গ্রামে কেটেছে আমার শৈশব ও যৌবন। এখানকার মানুষ উকিল মুন্সির গানের মতো সহজ-সরল ও উদার। এখানকার মাটিতে ফলে সোনালি ফসল। এখানকার জলমগ্ন মাছ আর মাঠভরা ধান। এখানকার জমির মতো মানুষের মনটাও উর্বর। খুব অল্পতেই এ অঞ্চলের মানুষ খুশি হয়। এ অঞ্চলের মানুষ বাইরে যেতে চায় না। কেন যাবে? মাঠ ভর্তি ধান-মাছ রেখে কোন দুঃখে বাইরে যাবে? কুয়াশার শীতল বাতাস, রৌদ্রের হাসিতে এখানকার মাঠ থেকে ভেসে আসে পাকা ধানের সুবাস। এই ধানের সুবাস নাকে নিয়ে কেউ অসুখী হতে পারে না। এমন অঞ্চলের মানুষ আমি। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা মো. মোজাহারুল ইসলাম। একজন মানুষ যখন আরেকজনকে দেখিয়ে বলে, ‘উনি মুক্তিযোদ্ধা মোজাহা ছেলে’; আমার বুকটা শান্তিতে ভরে যায়। বাংলার সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে আমার বাবাকে এক নামে সবাই চেনেন। বাবাও চিনতেন সবাইকে। নদীর মতো বিশাল তার মন। তিনি বেশিরভাগ পরিচিতকে নাম ধরেই ডাকতেন। কারো সঙ্গে দেখা হলে বাড়ির সবার নাম বলে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। বাবার ছায়ার পাশে বসতে বসতে মানবিকতা, উদারতা, আন্তরিকতা শিখেছি। বাবা বলতেন, ‘ভাষা শিখতে হবে। ভাষা শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কি বাংলা, কি ইংরেজি; দুটি ভাষাতেই পারদর্শী হতে হবে। নিজেকে প্রকাশ করার একমাত্র মাধ্যম ভাষা। ভাষা শিক্ষা ছাড়া জ্ঞানার্জন অসম্ভব।’ পরীক্ষায় ভালো ফলে তিনি অসম্ভব খুশি হতেন। স্কুলে আমার সামান্য অর্জনে আনন্দিত হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কথা শুনে কতই না আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন! সবার কাছে আমার ভালো কথা বলতেন। তিনি যে কত খুশি হয়েছিলেন, তা আজও মনে পড়ে। আমাদের এলাকাতে কোনো ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করলে তারা গ্রামে এলে তিনি আগ্রহ নিয়ে মিশতেন। আমার ছোটবেলায় এ রকম অনেক ছেলেদের প্রশংসা শুনিয়েছে আমার বাবা। আমার বাবার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। (চলবে…)

সান্তাহার ডটকম/০৯ জুলাই ২০২০ইং/এমএম