গুণীজন দৈনিক সান্তাহার সান্তাহার পৌরসভা

আক্ষেপ নিয়েই চলে গেলেন ‘ছুটির ঘণ্টা’র স্রষ্টা

“১৯৫৮ সালে পত্রিকায় দেখলাম এহতেশাম ‘এ দেশ তোমার আমার’ নামে একটি ছবি তৈরি করছেন। আমি আর সুভাষ দত্ত তখন এভারগ্রিন পাবলিসিটি নামের একটি ফার্মে সিনেমার ব্যানার করি। আমি ঢাকা আর্ট ইনিস্টিটিউট থেকে কেবল ডিপ্লোমা পাস করেছি। দত্তদা বললেন, ‘চলো যাই।’ তার আগে আমাদের শান্তাহারে তাদের মিনার সিনেমা হলে তিনি, তার ভাই মোস্তাফিজ ও তাদের মা যেতেন। সেভাবেই পরিচয়। তখন বংশালে এক বন্ধুর বাসায় থাকতাম। আমরা রাজার দেউড়িতে লিও ফিল্মসের অফিসে গেলাম। দেখা হলো না। তবে শান্তাহারে তার ম্যানেজার ইব্রাহিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন, ‘এহতেশাম দোতলায় থাকেন। ৯টার দিকে নিচে নামবেন।’ আমি অপেক্ষা করছি। ৯টায় ওস্তাদজি নামলেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘কী ব্যাপার?’ বললাম, আপনার ছবিতে শিল্পনির্দেশনা করতে চাই। ‘শিল্পনির্দেশনা তো এফডিসি থেকে করে। তাদের নিজস্ব শিল্পনির্দেশক আছে।’ ‘তা হলে কমার্শিয়াল পাবলিসিটির কাজ দেন।’ ‘সেই কাজ সুভাষ দত্ত করবে।’ ‘আমরা একসঙ্গে কাজ করি, এখানেও একত্রে কাজ করব।’ তখন তিনি আমাকে প্রস্তাব দিলেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দাও। আমি দোসানি সাহেবকে বলে দেব। সুযোগ পেলেই গুলিস্তানে গিয়ে ছবি দেখবে। নাজে গিয়ে ইংরেজি ছবি দেখবে।’ এভাবেই আমার সিনেমা দেখা ও বানানো শেখার শুরু। সময় পেলেই ছবি দেখতাম। প্রজেকশান হলে গিয়ে অপারেটরের কাছ থেকে নিয়ে রিল নেড়েচেড়ে দেখতাম।” ‘চলচ্চিত্রে আমার কথা’ বইয়ে এভাবেই লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন ভুবনে নাম লেখানোর ইতিহাস বলেছেন ইহলোক থেকে ছুটি নিয়ে পরপারে চলে যাওয়া ‘ছুটির ঘণ্টা’র স্রষ্টা আজিজুর রহমান।

আজিজুর রহমান একজন পুরোদস্তুর ভদ্র ও সজ্জন। তার উদাহরণ সকলের সঙ্গে সদ্ভাব। সুদূর কানাডা থেকে অসুস্থ শরীর নিয়েও চেষ্টা করেছেন সকলের খোঁজখবরের। শেষদিকে পরিবারের চাপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তাকে দূরে থাকতে হয়েছিল। কারণ করোনার মহামারীতে অনেক কাছের মানুষগুলোর মৃত্যু। অনেকের মৃত্যুর খবরও শেষদিকে তিনি জানতেন না। যেমন এটিএম শামসুজ্জামান, কবরী, ওয়াসিম, সাদেক বাচ্চু, ফকির আলমগীর, আলী যাকের- এদের কারোর মৃত্যুর খবর জানতেন না আজিজুর রহমান। খুব বেশি চাপাচাপি করলে স্ত্রী শামীমা রহমান বা মেয়ে বিন্দিকে দিয়ে মেসেঞ্জারে ফোন দিয়ে কথা বলতেন। তবে কারও মৃত্যুর খবর জানাতে বারণ ছিল। সে কারণে শেষদিকে ফোন খুব বেশি ধরিনি। কারণ আজিজুর রহমান ভাইয়া সকলের কথা জানতে চাইতেন, কিন্তু মিথ্যা বলতে হবে ভেবে এড়িয়ে যেতাম।

তবে তিনি চলচ্চিত্রকে খুব লালন করতেন। এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করত। যে কারণে অখ- অবসর সময়টাতে রঙ-তুলি নিয়ে জলরঙের ছবি আঁকতেন। কানাডায় মেয়ে আলিয়া রহমান বিন্দির ওখানে প্রায় থিতু হওয়ার আগে দেশেই তিনি অনেকগুলো ছবি এঁকেছিলেন। সেগুলো সযতনে গ্রীনরোডের বাসায় রাখা। টরন্টোতে পুরো করোনা সময়জুড়ে একের পর এক ছবি এঁকে গেছেন। শরীর যখন তীব্র খারাপ, অক্সিজেনের নল নাকে তখনো অবসর নেননি। প্রচুর ছবি এঁকেছেন। মাঝে একবার বলেছিলেন- তেপান্তর দেশে ফিরতে পারলে এবার একটা এক্সিবিশন করব, অনেকগুলো ছবি একেঁছি। হেল্প করতে হবে, কী রে করবি না? এমন অনেক পরিকল্পনার কথা জানাতেন। আবার ছবি বানাবেন সে কথাও বলতেন।

আজিজুর রহমানের মৃত্যুর খবরে আফসোস প্রকাশ করেছেন মধুমিতা সিনেমা হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ। বলেন, আমার পুরো জীবনে এত সহজ-সরল মানুষ আমি দেখিনি। বিশেষ করে এই অঙ্গনে। একজন নির্লোভ মানুষ জীবন ভর যিনি সৃষ্টি করে গেলেন। বিশেষ করে তার ‘জনতা এক্সপ্রেস’ বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। এমন চলচ্চিত্র নির্মাতার কপালে জোটে না স্বীকৃতি! এই লজ্জা পুরো ইন্ডাস্ট্রির।

একইভাবে আজিজুর রহমানের জীবদ্দশায় ২০১৭ সালে অভিনেতা ফারুক, অঞ্জনা, সাইদুর রহমান সাঈদ হতাশা প্রকাশ করে দাবি জানিয়েছিলেন- চলচ্চিত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রীয় সম্মাননার প্রধান দাবিদার আজিজুর রহমান। তবে এসবে কান দিতে নারাজ আজিজুর রহমান বরাবরই বলতেন- আমি ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’ কিংবা ‘জনতা এক্সপ্রেস’ এমন অনেক ছবি বানিয়েছি সমাজকে নাড়া দিতে। সেটা পেরেছি বলেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার মানুষ আমাকে চেনে। এর চেয়ে বড় সম্মান আর কী বা হতে পারে?

সকলেই আমরা জানি, এহতেশামের হাত ধরে শবনম, শাবানা, শাবনাজরা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য এদের গড়েপিটে শিল্পীর আকার দিয়েছেন এই আজিজুর রহমান। যার স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন তাদের কাছে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা পেয়ে। এ ব্যাপারে শবনম বলেন, আজিজ ভাইকে সেই শুরুর দিন থেকে ভাই হিসেবে জেনেছি। এর পর মা মারা যাওয়ার পর তিনি আজিজ ভাইকে আমাদের বড় ভাইয়ের মর্যাদা দেওয়ার নির্দেশ করে যান। রাখি বন্ধনটাও তার হাতে করেছি। তিনি আছেন মানে ভরসার জায়গা আছে। একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন। সব মিলিয়ে বলতে পারি ভাই হারানোর বেদনা সইতে হচ্ছে। বাকি জীবনে এমন অভিভাবক পাব না।

আজিজুর রহমান নেই এমন সংবাদে স্তম্ভিত পাকিস্তানের খ্যাতিমান অভিনেতা নাদিম। মুঠোফোনে বলেন, তার গাইডলাইন আমাকে নাদিম বানিয়েছে। তিনি অনেকের শীর্ষে ওঠার পথে ফুল বিছিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা সেই ফুলে সুভাষ ছড়াচ্ছি মাত্র। আশা করছি পরপারে ভালো থাকবেন আজিজ ভাই।

আজিজুর রহমান গুরুশিষ্য পরম্পরায় বিশ^াসী এক শিষ্য। ইন্ডাস্ট্রিতে একমাত্র শিষ্য তিনি এই পরম্পরার উত্তরসূরি। এহতেশামের হাত ধরে উঠে আসা আজিজুর রহমান ওস্তাদের তিনগুণ বেশি ছবি বানিয়েও তার সঙ্গে অ্যাসিস্ট করেছেন কোনোরূপ ডানবাম না ভেবেই। যে কারণে শুরুর দিন থেকেই তিনি এহতেশাম-মুস্তাফিজ, শবনম, শাবানাদের ভরসা হয়ে উঠেছিলেন।

তার অনেক গুণের অন্যতম চিত্রনাট্য অনুসারে স্কেচ করে দৃশ্য ধারণে যাওয়ার মুন্সিয়ানা। এটা সত্যজিৎ রায় করতেন। বাংলাদেশে সুভাষ দত্তও এই প্রক্রিয়ায় কিছু কাজ করেছেন তবে আজিজুর রহমান সারাজীবন স্কেচনির্ভর চিত্রনাট্য করে কাজ করে অসাধারণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত না হলেও সাধারণ মানুষের হৃদয়ে চিরদিন সম্মানিত থাকবেন আজিজুর রহমান। সংকটে হুইসেল বাজিয়ে জনতাকে সতর্ক করবেন। ওপারে ভালো থাকুন আজিজ ভাই।